ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তার (British Empire History in Bengali)
বর্তমান যুক্তরাজ্যের অধীনে থাকা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের প্রশাসনিক এলাকা গুলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল। একসময় ব্রিটিশরা পৃথিবীর মোট আয়তনের চারভাগের একভাগ অঞ্চল এবং পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ মানুষকে সরাসরি শাসন করতো। ছোট একটি দ্বীপরাষ্ট্র ব্রিটেন তাদের কূট-পরিকল্পনার মাধ্যমে গড়ে তুলেছিল পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য। আর সেই কারণেই বলা হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য কখনো অস্ত হয় না। তো চলুন আজ আমরা জেনে নিই ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যর বিস্তার এবং তাদের কুখ্যাত শাসন আমল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যাত্রা শুরু হয়েছিল 17 শতকের শুরুর দিকে। ফরাসিদের সাথে পাল্লা দিয়ে সেই সময় কিছু ব্রিটিশ জয়েন্ট স্টক কম্পানি উত্তর আমেরিকার বেশ কিছু অঞ্চল এবং ছোট ছোট কিছু ক্যারিবিয়ান দ্বীপে বাণিজ্য করতে গিয়ে এসব অঞ্চল দখল করে নেয়। সেসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পরবর্তীতে একটানা 200 বছর ব্রিটিশ রা সবচেয়ে শক্তিশালী জাতি হিসেবে বিশ্ব কে শাসন করেছে। ব্রিটিশ রা তাদের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে উপনিবেশ শাসনের ক্ষেত্রে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের চেয়ে এগিয়ে ছিল। তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার ছিল তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে আধুনিক বাণিজ্য ও সামরিক জাহাজ।
এছাড়া তারা উপনিবেশগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থা যাতায়াত ব্যবস্থা এবং তারের সাহায্যে দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কারণে নিজেদেরকে আধুনিক শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। কানাডা থেকে ইন্ডিয়া, অস্ট্রেলিয়া থেকে নাইজেরিয়া, ক্যারিবিয়ান থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল দখলের মাধ্যমে তারা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল 3 কোটি 37 লক্ষ বর্গকিলোমিটার। যা পৃথিবীর মোট আয়তনের চারভাগের একভাগ। বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ রা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লেও তাদের আরেকটি ব্রত ছিল ধর্মপ্রচার করা। নিজেরা সব রকমের অধর্ম চর্চা করলেও তাদের ভাবখানা ছিলো এমন যেন তারা সরাসরি ঈশ্বর কর্তৃক নির্বাচিত শাসক।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে আকর্ষণীয় উপনিবেশ ছিল ভারতবর্ষ। ভারতের কর্তৃত্ব লাভ করার কারণে ইউরোপের অন্যান্য ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটিশদের রীতিমতো হিংসা করতো। 17 শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশরা ভারতের খুব ছোট কিছুর সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা শাসন করতে শুরু করে। কিন্তু আঠারো শতকের মধ্যেই তারা ভারতীয় উপমহাদেশের সিংহভাগ অঞ্চল দখল করেছে নেয়। ব্রিটিশ রা মুলত ভারতীয় উপমহাদেশের কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছে এই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানীয় শাসকদের সহায়তায়।
প্রথমদিকে তারা ছোটো রাজাদের হয়ে অন্য রাজাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এরপর ভারতবর্ষের শাসক রা একসময় দেখতে পায় তারা নিজেরা নিজেদের সাথে লড়াই করতে করতে ততদিনে ব্রিটিশরা উপমহাদেশ গ্রাস করে ফেলেছে। ব্রিটিশরা তাদের কূট চক্রান্তের বলে ভারত মহাসাগরের দ্বীপ থেকে হিমালয় পর্যন্ত ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় 600 টি রাজ্য দখল করতে সক্ষম হয়। এই উপমহাদেশের মূল্যবান কাপড়, চা এবং মসলা ইউরোপ সহ পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে বিক্রির মাধ্যমে ব্রিটিশরা সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে। এছাড়া উপমহাদেশের জনগণের কাছ থেকে কর গ্রহণের মাধ্যমে তারা হাতিয়ে নিয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ।
ভারতীয় উপমহাদেশ ব্রিটিশদের কাছে ছিল সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতো। 1765 সালের পর থেকে নানা উপায়ে ব্রিটিশরা সাধারণ ভারতীয় জনগনের কাছ থেকে খাজনা সংগ্রহ করতে শুরু করে। সেই খাজনার টাকা দিয়েই ব্রিটিশরা তাদের ব্যবসার জন্য স্থানীয় পণ্য সামগ্রী কিনতে থাকে। অর্থাৎ ভারতে ব্যবসা করতে এসে ভারতীয় জনগণের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে সেই টাকায় তারা ব্যবসার মূলধন হিসেবে ব্যবহার করে।
এছাড়া ইউরোপের বাজারে ভারতীয় পণ্যের ব্যাপক চাহিদা থাকায় এসব পণ্য তার দ্বিগুন দামে বিক্রি করতো। ভারত বর্ষ থেকে সংগৃহীত পণ্যে ব্রিটিশদের ব্যাবসা জমে ওঠে অভাবনীয় পর্যায়। সেইসাথে নিজেরা কোন পণ্য উৎপাদন না করেও ইউরোপের বাজারে তারা সবচেয়ে বড় পুঁজিপতি বনে যায়। ব্রিটেনের শিল্প বিপ্লবের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় লোহা, আলকাতরা এবং গাছের গুড়ি বিপুল পরিমাণে ভারত থেকে পাচার করে নিয়ে যায়।
একদিকে ভারতের অর্থ, অন্যদিকে খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাটের মাধ্যমে ব্রিটিশ রা তাদের শিল্প বিপ্লব ঘটায়। শুধু তাই নয় ভারতের লুণ্ঠিত সম্পদ দিয়েই ব্রিটিশরা কানাডা অস্ট্রেলিয়া সহ অন্যান্য অঞ্চলের উপনিবেশগুলোতে শিল্পায়নে বিনিয়োগ করে। একটি গবেষণায় জানা যায় 1765 সাল থেকে 1938 সালের মধ্যে 45 ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সম্পদ ব্রিটিশরা ভারত থেকে পাচার করে নিয়ে গেছে। এই 45 ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বর্তমানে যুক্তরাজ্যের জিডিপির প্রায় 17 গুণ বেশি।
ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের এই লুটরাজের কোন অধ্যায় দেওয়া হয় না। সারা বিশ্বব্যাপী অন্যায় আর শোষণের মাধ্যমে তারা যে সম্পদ গড়ে তুলেছে তার কোন সঠিক বিবরণ নেই তাদের পাঠ্যপুস্তকে। তৃতীয় বিশ্বের দেশ বলে যাদেরকে আজ তার ছোটো দৃষ্টিতে দেখে অথচ তারা জানেই না তাদের পূর্বপুরুষ এইসব উপনিবেশ কে ইচ্ছাকৃতভাবে দারিদ্র সীমার নিচে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। বরং ব্রিটিশ উপনিবেশের আভিজাত্য তারা তুলে ধরে তাদের বিদ্যালয়গুলোতে। যার ফলে এখনো অধিকাংশ ব্রিটিশ তাদের ঔপনিবেশিক অতীত নিয়ে গর্ববোধ করে।সেখানকার বহু নাগরিক এখনো মনে করে ব্রিটিশ শাসনের ফলে উপনিবেশগুলো লাভবান হয়েছে।
2014 সালের একটি সার্ভে তে দেখা যায় 43% ব্রিটিশ মনে করেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভালো সাম্রাজ্য ছিল । যেখানে মাত্র 20 শতাংশ ব্রিটিশ মনে করে ব্রিটিশ উপনিবেশ গুলো খারাপ ছিল। আর 25% বলেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভালো ছিল না আবার খারাপ ও ছিলনা। সমালোচকদের দাবি ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশগুলোতে গণহত্যা, দুর্ভিক্ষ এবং নির্যাতন নিপিরণের মত ঘৃণ্য ঘটনা ঘটিয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা বিভিন্ন দুর্ভিক্ষে ভারতের প্রায় 1 কোটি 20 লাখ থেকে 2 কোটি 90 লাখ মানুষ মারা যায়।
অথচ একই সময়ে ভারত থেকে বছরের লাখ লাখ টন গম পাচার হতো ব্রিটেনে। 1943 সালে বাংলায় যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তাতে শুধু মারা যায় 40 লাখ মানুষ। অথচ তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল সেসময় বাংলায় উৎপাদিত খাদ্যশস্য ব্রিটিশ সেনাদের জন্য সরবরাহ করতে আদেশ দিয়েছিল। উইনস্টন চার্চিল বাংলার দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে বলেছিল আমি ভারতীয়দের ঘৃণা করি। কারণ তারা মানুষ নয়, পশুর মতো। আর তাদের ধর্ম ও পাশবিক। এই দুর্ভিক্ষের জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। কারণ খরগোশের মত অসংখ্য সন্তান জন্ম দিয়ে দ্রুত জনসংখ্যা ভারতের অভাবে এই দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। ভারতবর্ষে মানুষের প্রদত্ত খাজনা যদি ভারতবর্ষের কল্যাণে ব্যয় করা হতো তাহলে কয়েক শত বছর ধরে এ অঞ্চলের মানুষের সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে হতো না। ব্রিটিশরাজ ভারতবর্ষের দ্বিতীয় বৃহৎ সাম্রাজ্য হওয়ার পরেও তারা এই অঞ্চলের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনতে পারেনি।
অতীতে ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ছিল মৌর্য সাম্রাজ্য। আর ভারতীয় উপমহাদেশের তৃতীয় বৃহৎ সাম্রাজ্য ছিল ব্রিটিশদের ঠিক আগেই শাসন করা মুঘল সাম্রাজ্য।
তো এই ছিলো ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তার।
0 Comments