ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস (Mughal Empire History in Bengali)

মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস (Mughal Empire History in Bengali) 
ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় মুঘল সাম্রাজ্য। কাবুলের সিংহাসন আরোহণের মাধ্যমে মুঘলদের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ভারতবর্ষের সিংহভাগ অঞ্চল মুঘলদের অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে তার চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। শিল্প-সংস্কৃতি অভিনব শাসনব্যবস্থা ও নান্দনিকতার জন্য মুঘল সাম্রাজ্য যেমন বিখ্যাত, ঠিক তেমনি আভ্যন্তরীণ কলহ এবং মাত্রাতিরিক্ত বিলাসিতার জন্য মুঘলরা সমালোচিতও বটে। 

মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর এর হাত ধরে 1526 সালে যে সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল 1857 সালের দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের রেঙ্গুন নির্বাসনের মধ্য দিয়ে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। তো চলুন জেনে নিই ভারতবর্ষে প্রায় 300 বছর শাসন করা মুঘল সাম্রাজ্য সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য।

মুঘল সাম্রাজ্য ভারতীয় উপমহাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম সাম্রাজ্য। ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যঃ ছিল মৌর্য সাম্রাজ্য এবং ব্রিটিশ রা ছিলো ভারতের দ্বিতীয় বৃহৎ সাম্রাজ্য। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর 1526 সালে পানিপথের যুদ্ধে আফগান শাসক ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা করেন।

মোঘলরা মূলত মঙ্গোলীয় এবং তুর্কী বংশোদ্ভূত। মুঘল সম্রাট বাবর পিতার দিক থেকে তৈমুর লং এবং মাতার দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর। ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা বর্তমান বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল। 

মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর 1483 সালের 20 ফেব্রুয়ারি মধ্য এশিয়ার বর্তমান উজবেকিস্তানের ফরগনা রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ওমর শেখ মির্জা ছিলেন ফরগনা রাজ্যের অধিপতি। পিতার মৃত্যুর পর মাত্র 11 বছর বয়সে বাবর ফরগনা রাজ্যের সিংহাসন আরোহন করেন। সিংহাসনে বসার পর তিনি সাম্রাজ্যঃ বৃদ্ধির লক্ষ্যে উজবেকিস্তানের সমরকন্দ দখলের পরিকল্পনা করেন। 

1497 সালে বাবর সমরকন্দ দখল করতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে বাবরের অনুপ্সথিতিতে 1501 সালে উজবেক নেতা সাইবানি খান সমরকন্দ দখল করে নেয়। তখন নিজের রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে বাবর হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করে কাবুলে চলে আসেন। সেসময় কাবুলের শাসক গোষ্ঠীর মধ্যকার অন্তর্কলহের সুযোগে 1504 সালে বাবর কাবুল দখল করে নেয়। এরপর পারস্যের সম্রাট শাহ ইসমাইলের সাহায্যে 1511 সালের দিকে বাবর পুনরায় সমরকন্দ জয়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হোন। এর ফলে বাবর তার নতুন সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য ভারতবর্ষের দিকে দৃষ্টিপাত করেন। বাবর 1519 থেকে 1522 সালের মধ্যে আরো অনেক গুলি জায়গা দখল করে নেয়। এরপর 1524 সালে বাবর বর্তমান পাকিস্তানের লাহোর নিজের অধিকার নিয়ে আসেন। 1525 সালে বাবুর দিল্লি জয় করার লক্ষ্যে কাবুল থেকে অভিযান শুরু করার পর দৌলতখান কে পরাজিত করে পাঞ্জাব দখল করে নেন।

1526 সালের 12 এপ্রিল বাবর পানিপথ প্রান্তরে সৈন্য সমাবেশ করে। এই পানি পথে প্রান্তরে ঐতিহাসিক পানিপথের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অভিনব কৌশল ও দক্ষতায় বাবর মাত্র 12 হাজার সৈন্য নিয়ে আফগান শাসক ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করেন। যুদ্ধে জয়লাভের ফলে জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর দিল্লির ও আগ্রা দখল করে নেয়। এর মধ্য দিয়েই মূলত ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের যাত্রা শুরু হয়। 

1526 সালে দিল্লি দখল করে মুঘল সম্রাট বাবর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল বিয়ানা, গাজীপুর, গোয়ালিয়র দখল করে নেয়। 1526 থেকে 1529 সালের মধ্যে বিভিন্ন যুদ্ধে রাজপুত ও অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজিত করে পাটনা দখল করে নেয়। অন্যদিকে বিহার, বাংলা সহ বিভিন্ন রাজ্যে বাবরের অধীনে চলে আসে। মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মাত্র চার বছরের মাথায় 1530 সালে মাত্র 47 বছর বয়সে সম্রাট জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর মৃত্যুবরণ করেন। 

মুঘল সম্রাট জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হুমায়ূন মুঘল সাম্রাজ্যের সিংহাসন আরোহন করেন। সম্রাট বাবর তার শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা কাবুল থেকে গৌগুড়া, গোয়ালিয়র থেকে বাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত করলেও সেই সময় ভারতবর্ষে শাসনতান্ত্রিক জটিলতা এবং বিদ্রোহ সহ নানা ধরনের অস্থিরতা বিদ্যমান ছিল। এরই প্রেক্ষাপটে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের শাসনামলেও বিরূপ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। 

এরপর যুদ্ধে সম্রাট হুমায়ুন তৎকালীন দুর্ধর্ষ সমর নেতা শের শা কাছে পরাজিত হয়, ফলে শেরশা দিল্লি আগ্রা দখল করে নেয়। পরবর্তীতে পারস্যের সম্রাট শাহ তমাশ্পের সহযোগিতায় হুমায়ুন প্রথমে লাহোর উদ্ধার করেন। এরপর 1555 সালের জুলাই মাসে সম্রাট হুমায়ুন দিল্লি আগ্রা দলের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে পুনরায় মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর আকস্মিকভাবে 1556 সালে সম্রাট হুমায়ূনের মৃত্যু ঘটে। 

হুমায়ুনের মৃত্যুর পর মুঘল সিংহাসন আরোহণ করেন তার ছেলে সম্রাট আকবর। ভারতবর্ষের শাসনতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা আনার লক্ষে তিনি আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। অন্যান্য দেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে মনোযোগী ছিলেন সম্রাট আকবর। তিনি মোগলদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাজপুতদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য এক রাজপুত নারীকে বিবাহ করেন। এর ফলে মুঘল সাম্রাজ্য তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বড় সীমানা অধিকারী হয়। ফতেপুর সিক্রি, অমৃতসর মন্দির দিল্লির জামে মসজিদসহ বিভিন্ন ইমারত নির্মাণের কারণে সেই আমলটি শিল্প সংস্কৃতি বিকাশে উর্বর সময় হিসেবে বিবেচিত হয়। ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রকল্পে সম্রাট আকবর দ্বীন-ই-ইলাহী নতুন এক ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেন। এই ধর্মের অনুসারী ছিল মাত্র 18 জন। সম্রাট আকবরের সময়ে মুঘল সাম্রাজ্য সবচেয়ে বিকশিত হয়েছিল। আর তাই তাকে শ্রেষ্ঠ মুঘল সম্রাট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 1605 সালে সম্রাট আকবর মৃত্যুবরণ করেন। 

মুঘল সাম্রাজ্যের চতুর্থ সম্রাট জাহাঙ্গীর 1605 থেকে 1627 সাল পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। মাদক ও নারীতে আসক্ত সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্য কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে তার শাসনামলেই সমগ্রবাংলা অঞ্চল মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। 1610 সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর বাংলার রাজধানী বিহারের রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করেন। তিনি সরকারি কাজে বাংলা ভাষার পাশাপাশি ফরাসি ভাষার প্রচলন করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর 1627 সালে মৃত্যুবরণ করেন।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের পুত্র খুররম সম্রাট শাহজাহান নাম ধারণ করে 1628 সালে মুঘল সাম্রাজ্যের পঞ্চম সম্রাট হিসেবে দিল্লির সিংহাসনে আরোহন করেন। সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলকে মুঘল শাসনামলে স্বর্ণযুগ হিসেবে অভিহিত করা হয়। শিল্প সংস্কৃতি বিকাশে সম্রাট শাহজাহানের পৃষ্ঠপোষকতার স্বীকৃতি হিসেবে তাকে পৃন্স অফ বিল্ডার্স আখ্যা দেয়া হয়। সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী মমতাজ এর প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার নিদর্শন হিসেবে যমুনা নদীর তীরে দুর্লভ পাথরের তৈরি সমাধি সৌধ তাজমহল নির্মাণ করেন। সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে নির্মিত স্থাপত্য গুলির মধ্যে রয়েছে দিল্লির লালকেল্লা, আগ্রা দুর্গ দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস প্রভৃতি। সম্রাট শাহজাহানের অমর সৃষ্টি হচ্ছে কোহিনুর হীরা, মনি মুক্তা খচিত ময়ূর সিংহাসন। যা 1739 সালে পারস্যের সম্রাট নাদির শাহ লুন্ঠন করে নেয়। সম্রাট শাহজাহানের চার পুত্রের মধ্যে অন্তর্কোন্দলের বলি হিসেবে পত্র ঔরঙ্গজেব তাকে গৃহবন্দী করেন। 1666 সালে সম্রাট শাহজাহান আগ্রার দুর্গে বন্দী থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। 

মুঘল আমলে নির্মিত ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রায় অবস্থিত পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়কর এক স্থাপনা হলো তাজমহল। তাজমহলের মত এমন নিদর্শন পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের স্মৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা জানাতে তাজমহল তৈরি করেছিলেন সম্রাট শাহজাহান। সেই অনন্য কীর্তি তাজমহল' আজও বিশ্ববাসীর কাছে এক অপার বিস্ময়ের নাম।

সম্রাট শাহজাহানের উত্তরাধিকারী চার পুত্রের প্রতিযোগিতায় ঔরঙ্গজেব অন্যদের পরাস্ত করে। ঔরঙ্গজেব আলমগীর নাম ধারণ করে সিংহাসন আরোহন করেন। সম্রাট ঔরঙ্গজেবের শাসনামলে ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য সবচেয়ে বেশি কলঙ্কিত হয়। 
 প্রায় 49 বছরের শাসনামলে সম্রাট ঔরঙ্গজেব তার রাজ প্রজাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। 1707 সালে সম্রাট ঔরঙ্গজেব মৃত্যুবরণ করেন। 

সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্যের বিশৃঙ্খলা ও বিদ্রোহ দেখা দেয় সম্রাট ঔরঙ্গজেব পুত্র প্রথম বাহাদুরশাহ প্রশাসন সংস্কারের চেষ্টা করেন। কিন্তু 1712 সালে প্রথম বাহাদুর শাহ মৃত্যুবরণ করলে মুঘল সাম্রাজ্য পতনের যাত্রা শুরু হয়। সম্রাট মহম্মদ শাহের শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে শুরু করে। এ সময়ে মধ্য ভারতের অধিকাংশ এলাকা মারাঠা সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

নাদির শাহের সময়ে দিল্লি আক্রমণ করলে মুঘল শক্তি হ্রাস পেতে শুরু করে। সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম মুঘল সাম্রাজ্যের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালালেও ব্যর্থ হয়। 1761 সালে দ্বিতীয় শাহ আলম আফগান আমির আহমদ শাহ আবদালির সহযোগিতায় মারাঠা বাহিনীকে পরাজিত করে। কিন্তু 1776 সালে মারাঠারা পুনরায় দিল্লি দখল করে নেয় শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ এর শাসনামল শুধুমাত্র শাহজাহানবাদ শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সিপাহী বিদ্রোহের সমর্থন দানের কারণে তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ দায়ের করে ব্রিটিশরা। এর প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত রেঙ্গুন বর্তমান মিয়ানমারের নির্বাসনে পাঠানো হয়। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ এর নির্বাচনের মধ্য দিয়েই মূলত ভারতবর্ষে প্রায় সাড়ে 300 বছর শাসন করা মুঘল সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ঘটে।

তো এই ছিলো মুঘল সাম্রাজ্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।। 

Post a Comment

0 Comments